ফরিদপুর প্রতিনিধি:
উন্নত জীবনের আশায় বা হতদরিদ্র পরিবারের স্বচ্ছলতা ফেরাতে দালালদের প্রলোভনের ফাঁদে পড়ে অবৈধপথে ইতালি যাত্রা বেড়েই চলেছে ফরিদপুরে। এমন নেশায় বিভোর হয়ে উঠেছেন জেলার উঠতি বয়সি তরুণরা। মরণের ঝুঁকি জেনেও ইতালি যাওয়ার স্বপ্নে মেতে উঠেছে তাঁরা। তাঁদের এ যাত্রায় কখনও পড়তে হয় মাফিয়া চক্রের হাতে বা কখনও উত্তাল ভূমধ্যসাগরে ডুবতে হয়। আর তাতেই ঘোর বিপদ নেমে আসে তাঁদের জীবনে বা পরিবারের মাঝে।
এমনই স্বপ্নে বিভোর হয়ে যাত্রাপথে লিবিয়ায় মাফিয়াদের হাতে জিম্মিদশায় নির্যাতনের শিকার হয়ে গত দুই মাসে ফরিদপুরের চার যুবকের মৃত্যুর খবর মিলেছে। এমনকি জিম্মিদশায় নির্যাতনের শিকার হয়ে লাখ লাখ টাকায় মুক্তি মিলেছে কারও কারও। এছাড়া ওই চক্রের ফাঁদে জিম্মি রয়েছেন অনেকে, প্রতিনিয়ত চলছে তাঁদের ওপর অমানবিক নির্যাতন।
সম্প্রতি লিবিয়া মাফিয়া চক্রের হাত থেকে মুক্তি পেয়ে দেশে ফিরেছেন ফরিদপুরের সালথা উপজেলার রামকান্তপুর গ্রামের টিটুল মিয়ার পুত্র শাকিল মিয়া (২৪)। ওই চক্রের হাতে জিম্মি হয়ে অবর্ণনীয় নির্যাতনের শিকার হয়েছেন সে। তাঁর সাথে কথা হয় আজকের পত্রিকার। তাঁর চতুরতায় বেরিয়ে এসেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। অত্যন্ত তীক্ষèভাবে সংগ্রহ করেছেন ওই মাফিয়া চক্রের তথ্য।
শাকিলের ভাষ্যমতে ও অনুসন্ধানে জানা যায়, ওই চক্রের মূলহোতা কুমিল্লার শরিফুল হোসেন যিনি মাফিয়া শরিফ নামে পরিচিত। লিবিয়ার ত্রিপলী বিভাগের জোয়াইন নামক এলাকায় তাঁর রয়েছে বিশাল ‘গেম ঘর’। যেখানে বন্দি রেখে নির্যাতন করে মুক্তিপণ আদায় করা হয়। সাংবাদিকদের হাতে শরিফের পাসপোর্টের একটি কপি সংগৃহীত রয়েছে। পাসপোর্টে দেয়া জন্মনিবন্ধন সার্টিফিকেট নাম্বার চেক করে দেখা যায়, সে কুমিল্লা জেলা সদরের বাসিন্দা এবং আনোয়ার হোসেন ও খোদেজা বেগম দম্পতির পুত্র। শ্রমিক হিসেবে লিবিয়া গিয়ে সেখানে ‘মাফিয়া’ বনে যান অক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন এই শরীফ। তার ‘সিন্ডিকেটে’ যুক্ত করে নেন আরও কিছু বাংলাদেশিকে।
শরিফের দলে রয়েছে ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলার ইমন (২৮), মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার বিজয় তালুকদার ও খান নামে পরিচিত এক ব্যক্তি, সিলেটের সোহাগ ও ভৈরবের ইমন মোল্যা ও মুন্সি মো. কুদরতল্লাহ। এরমধ্যে বিজয় তালুকদার মুক্তিপণের টাকা উঠানোর দায়িত্বে রয়েছেন।
এই চক্রের মাধ্যমে সারাদেশে ছড়িয়ে রয়েছে দালাল চক্র। যারা পরিচিত ও এলাকার তরুণদের ফুসলিয়ে ইতালি যাওয়ার স্বপ্ন দেখান।
অনুসন্ধানে এই চক্রেরও কয়েকজনের নাম জানা গেছে। তাঁদের মধ্যে রয়েছে, ফরিদপুরের সালথা উপজেলার রামকান্তপুর গ্রামের মকবুল ঠাকুর ওরফে মুকুল ঠাকুর, জেলা সদরের চরমাধবদিয়ার নুরু উদ্দিন, রমজান মোল্যা ও শাহীদ হাসান ঝন্টু, ভাঙ্গা উপজেলার ঘারুয়া ইউনিয়নের ডাঙ্গারপাড় গ্রামের শেখ মেহেদি, গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলার মহারাজপুর গ্রামের শাহিন খাঁর ছেলে শাকিল খাঁ ও নগরকান্দা উপজেলার গজারিয়া গ্রামের সালাম কাজীর ছেলে আলামিন কাজী।
গত দুই মাসে এসব চক্রের হাত ধরে ইতালি যাওয়ার উদ্দেশ্যে লিবিয়ায় গিয়ে নির্যাতনের শিকার হয়ে মারা গেছেন ফরিদপুরের চার যুবক। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন- সালথা উপজেলার বল্লভদী ইউনিয়নের চরবল্লভদী গ্রামের কৃষক মো. ইউনুস মুন্সীর ছেলে রিয়াজ মুন্সি (২০), ভাঙ্গা উপজেলার ঘারুয়া ইউনিয়নের ডাঙ্গারপাড় গ্রামের কৃষক শেখ নূর হোসেনের ছেলে শেখ নাঈম (২৫), জেলা সদরের নতুন ডাঙ্গী গ্রামের ইউনুস বেপারীর পুত্র রিয়াজুল ইসলাম ও কানু মাতুব্বরের ডাঙ্গী গ্রামের মো. সোহাগ হোসাইন।
এদের মধ্যে গত ০৮ সেপ্টেম্বর লাশ আসে সালথার রিয়াজ মুন্সির। বিষয়টি নিশ্চিত করে নিহতের চাচাতো ভাই কালাচাঁদ মুন্সি। তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, মুকসুদপুরের শাকিল খা ও নগরকান্দার আলআমিন কাজীর ফাঁদে পড়ে ইতালি যাওয়ার উদ্দেশ্যে লিবিয়ায় যায় রিয়াজ। তাতে ১৫ লাখ টাকা খরচ হয়। এরপর লিবিয়ায় তাকে কয়েকমাস তাকে আটকে রেখে চক্রটি আরও ১৫ লাখ টাকা দাবি করে নির্মম নির্যাতন চালাতে থাকে। এতেই তাঁর মৃত্যু হয়েছে।’
দালাল চক্রের ফাঁদে পড়ে উন্নত জীবনের আশায় ইতালি যাওয়ার স্বপ্ন বুনে ভাঙ্গার শেখ নাঈম (২৫)। কিন্তু সেই স্বপ্ন লিবিয়ায় গিয়ে ফিকে হয়ে যায়। গত ২৩ আগস্ট পরিবারের কাছে খবর আসে মাফিয়াদের নির্যাতনে নাঈম বেঁচে নেই! এর মাঝে ২০ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে চক্রটি।
এদিকে লিবিয়ায় নির্যাতনকালে জেলা সদরের চরমাধবদিয়া ও নর্থচ্যানেল ইউনিয়নের দুই যুবক মারা যায়। গত ১০ আগষ্ট নতুন ডাঙ্গী গ্রামের রিয়াজুল ইসলাম এবং ১১ আগষ্ট কানু মাতুব্বরের ডাঙ্গী গ্রামের মো. সোহাগ হোসাইনের মৃত্যুর খবর আসে। তারা দু’জন জ্বর ও শ্বাস কষ্টে মারা গেছে বলে জানানো হলেও পরিবারের সদস্যরা তা মানতে নারাজ। তারা জানান, মৃত্যুর পরে যে ছবি দেখানো হয়েছিলো তাতে আঘাতের অনেক চিহ্ন রয়েছে। তাদের দাবী, নির্যাতনের কারণেই মৃত্যু হয়েছে যুবকদ্বয়ের। তারা অন্তত লাশ ফেরত পাওয়ার দাবী জানিয়েছেন। একইসাথে নিঁখোজ রয়েছে ওই এলাকার আরো অন্তত ১২ জন।
মাফিয়াদের হাতে জিম্মি শাকিলের লোমহর্ষক নির্যাতনের বর্ণনা:
অপরদিকে এই চক্রের সদস্য মুকুল ঠাকুরের প্রলোভনে পড়ে গত জানুয়ারিতে লিবিয়ায় পৌছান সালথার শাকিল মিয়া। এরপর দীর্ঘ ২ মাস ১৭ দিন অবর্ণনীয় নির্যাতনের শিকার হয়ে মুক্তিপণ দিয়ে দেশে ফিরে এসেছেন।
শাকিল মিয়া জানান, যাত্রাপথে তাকে দুবাই নিয়ে ২৫ দিন রাখা হয়। সেখান থেকে লিবিয়ার ব্যাঙ্গাচি শহরে নিয়ে যাওয়া হয়। পরেরদিন সকালে দুইদিনের যাত্রা শেষে নেয়া হয় ত্রিপলী নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ছোট্ট একটি রুমে প্রায় ৪৫ জনকে রাখা হয়। সেখানে দুদিন থাকার পর মুকুল ঠাকুরকে সে ফোন দিয়ে বিষয়গুলো জানালে সেখানেই থাকতে বলে এবং পরিবারের নিকট থেকে ১২ লক্ষ টাকা নিয়ে নেয় চক্রটি। এরপর সেখানে প্রায় একমাস পর্যন্ত আটকিয়ে রাখে।
শাকিল মিয়া বলেন, ‘হঠাৎ একদিন ফোন করে মুকুল ঠাকুর আমাদের ইতালি যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হতে বলে। পরেরদিন সকালে চারজনকে গোপনে একটি গাড়িতে করে প্রায় দুইশ কিলোমিটার দূরে জোয়ারা নামক এলাকায় নিয়ে যায়। ওই এলাকায় গেম ঘর নামক জায়গায় আমাদের ৪০ দিন রাখে। এই ৪০ দিন আমাদের সকালে একটি করে খবজা বা রুটি খাবার দেয়া হতো এবং রাতের দিকে খিচুরির মতো কিছু খাবার দেয়া হতো। জীবন বাঁচানোর তাগিদে সেগুলো খাইতাম।
আবারও এক ব্যক্তি এসে আমাদের প্রস্তুত হতে বলে। প্রায় ৪০ দিন পর আমাদের সাগরপাড়ে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে মোট ৫২ জনকে একটি বোট উঠায়। এরপর সাগরের পাশ দিয়ে ড্রাইভার চালাতে থাকে। প্রায় দুই ঘন্টা পর তিউনিসিয়ায় সাগরপাড়ে গিয়ে বলে এটা ইতালি এবং নামতে বলে। একথা বলার পরই ড্রাইভার পালিয়ে চলে যায়। তখন দালালকে ফোন দিলে আমাদের উপরে উঠতে বলে। উপরে উঠার সাথে সাথেই তিউনিসিয়ার পুলিশ আমাদের গ্রেপ্তার করে। সেখানে একদিন আটক রেখে পরেরদিন লিবিয়া পুলিশের (মিলিশিয়া) হাতে তুলে দেয়। সেখানে পাঁচদিন একটি রুমে আটকিয়ে রাখা হয়। ঠিকমতো খাবার দিতো না, নোংরা পানি খাবার দিতো। ক্ষুদার যন্ত্রণায় কান্না করতাম।’
দালাল চক্র ১৫ লক্ষ টাকায় বিক্রি করে আটজনকে:
শাকিলের ভাষ্যমতে, সেখান থেকে চারজন, পাঁচজনকে আলাদা আলাদা করে নিয়ে যাওয়া হয়। পাঁচদিন পর আমিসহ আটজনকে পুলিশের একটি গাড়িতে নিয়ে যায়। রাত একটার দিকে টাকার বিনিময়ে একটি ক্যাম্পে পৌছে দেয় পুলিশ। তখন এক মাফিয়া এসে বলে তোরা কার লোক, তখন আমি বলি নুরু ও মুকুলের লোক। তখন এক মাফিয়া তাঁদের জানায়, সকলকে ১৫ লক্ষ টাকায় বিক্রি করে দিয়েছে নুরু ও মুকুল।
নিয়ম করে দুই বেলা নির্যাতন করা হতো।
শাকিল বলেন, ‘মাফিয়ারা আমাদের বাড়িতে ফোন দিতে বলে। তখন আমি বাড়িতে জানাই, দালালরা আমারে বিক্রি করে দিছে, দুদিনের মধ্যে ১৫ লক্ষ টাকা না দিলে আমাকে মাইর্যা ফেলবে। ওই মুহুর্তে আমার বাবার ফোন কেটে গেলে তারা আমাকে প্রচন্ড মারধর করে। একজন চেয়ারে বসে থাকে এবং আটজন দাড়িয়ে থেকে বাড়িতে ফোন কথা বলতে বলে। তাঁদের শেখানো কথা না বললে তখন লোহার পাইপ দিয়ে পেটাতে থাকে। এভাবে অন্ধকার একটি রুমে প্রতিদিন দুই বেলা করে ১৭ দিন নির্যাতন করে আমাকে। এরপর আমার বাড়ি থেকে টাকা পাঠালে ওই অন্ধকার রুম থেকে আমাকে বের করে, তখন আমি সূর্যের আলোর দিকে তাকাতে পারতাম না।
টাকা না দিলে কিডনি কেটে বিক্রি করা হতো:
শাকিলের ভাষ্যমতে, ওই গেম ঘরে তিন থেকে চারশ জনকে আটকে রাখা হয়। আমার কক্ষে প্রায় ২৫ জনকে আটকিয়ে নির্যাতন করে। কারো বাড়ি থেকে টাকা না দিলে খাবারের সাথে কিছু খাইয়ে অজ্ঞান করা হতো। এরপর তাঁদের কিডনি কেটে নিয়ে বিক্রি করে দেয়া হতো। এসব কিডনি স্পেনসহ ইউরোপ দেশে পাঁচার করে মাফিয়ারা। এরপর অনেকে মারা যায়।
মুক্তিপণের টাকা নেয়া হয় মাদারীপুর থেকে:
শাকিলের মুক্তিপণের ১৫ লক্ষ টাকা দেয়া হয় মাদারীপুরের রাজৈর থানার কলাগাছিয়া নামক এলাকার একটি ফাঁকা মাঠ থেকে। টাকা আদায়ের সময় শাকিলের পাশে বসে তাঁর বাবাকে ভিডিও কল দিয়ে নির্দেশনা দেন বিজয় তালুকদার। শাকিলের বাবা টিটুল মিয়া আজকের পত্রিকাকে বলেন, অনেক কষ্ট করে জমিজমা বিক্রি করে এবং ধারদেনা করে একাই একটি ব্যাগে ভরে ১৫ লক্ষ টাকা নিয়ে যাই। প্রথমে আমাকে ভাঙ্গা গোলচত্ত্বরে যেতে বলে। সেখান থেকে ফোন দিয়ে মাদারীপুরের দিকে যেতে বলে। এরপর কলাগাছিয়া কলেজের পাশ দিয়ে ফা^কা মাঠের মধ্যের দিয়ে হাটতে বলে। কিছুদূর যাওয়ার পর দেখি এক লোক মাঠের মধ্যে ক্ষেত কোপাচ্ছে। তাঁর কিছুদূরে বোরকা পড়া একজন মহিলাকে দেখা যায়। এ সময় একটি তালগাছের নিচে টাকার ব্যাগ রাখতে বলে এবং তাঁদের নির্দেশনা অনুযায়ী সেখানে টাকা রেখে দ্রুত চলে আসি।
নির্যাতন ও মুক্তিপণ আদায়ের বিষয়ে গত ০২ সেপ্টেম্বর লিবিয়ার ত্রিপলীতে বাংলাদেশ দূতাবাস প্রধান বরাবর একটি অভিযোগ দিয়েছেন শাকিল হোসেন। অভিযোগটি ওইদিনই দূতাবাস গ্রহণ করে। ওই অভিযোগে মাফিয়া চক্র ও দালালদের বিষয়ে তুলে ধরেন।
এই চক্রের একজন কুদরত উল্লাহর সাথে যোগাযোগ হয় এ প্রতিবেদকের। তবে অন্যদের সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব নয় বলে তিনি বলেন। কুদরত উল্লাহ দাবি করেন, ‘তিনিও মাফিয়াদের হাতে নির্যাতিত হয়েছেন। ক্যাম্পে থাকাকালীন শরিফ ও ইমন মোল্যার নেতৃত্বে অন্যদের মারধর করতেন।’
Somajer Alo24
Leave a Reply