গত শুক্রবার রাতে ফরিদপুরের ভাঙ্গায় মহাসড়কের খাড়াকান্দি এলাকায় একটি বড় ধরনের সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। সেখানে ঘটনাস্থলেই ৪ জন মারা যান, আহত হন ৬ জন। এ দুর্ঘটনার খবর পেয়ে ছুটে যান স্থানীয় বাসিন্দা কাউসার মাতুব্বর। তিনি ঘটনাস্থল থেকে হতাহতদের উদ্ধার করতে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসকে সহায়তা করেন। উদ্ধারকালে মারা যাওয়া একজনের প্যান্টের পকেটে রক্তে ভেজা একটি প্যাকেট দেখতে পান কাওসার। প্যাকেটের মধ্যে ছিল সোনার গহনা। মূল্যবান এই গহনা নিজের পরিবারের কাছে রেখে পরে সেই মৃত ব্যক্তির স্বজনদের কাছে ফিরিয়ে দিয়েছেন তিনি।
কাউসার সোনার গহনা ফিরিয়ে দেয়ায় গর্বিত তার মা। ছেলের অভাব অনটনের সংসারে অনেক প্রয়োজন থাকলেও অন্যের সম্পদে লোভ নেই তাদের। কাওসারের বৃদ্ধা মা মুন্নুজান বেগম (৮৫) বলেন, ‘আমার ছাওয়াল সোনা দিয়্যা দিছে, আমি খুশি হয়েছি। আমি তারে কইছি, বাজান তোমার ছেলেরা রোডে থাহে, আমার আরেডা ছাওয়াল গাড়ি চালায়, তুমি এই জিনিস যার তারে খুইজ্যা দিয়া দেও।’
কথা হয় কাউসারের স্ত্রী শাবানা আক্তারের সঙ্গে। স্বামীর সততা নিয়ে গর্ব আছে তার, এটাই তার অহংকার। তার স্বামী চার জনের লাশ উদ্ধার করেন। সেসময় আহত কয়েকজনকে হাসপাতালেও পাঠানো হয়। এসময় হঠাৎ রক্তাক্ত একটি কাগজে মোড়ানো কিছু গহনা পায় কাওসার। এরপর সেই গহনা বাড়িতে নিয়ে তিনি বলেন- এই সোনা তোমার ঘরে উঠাইয়ো না। ‘অ্যাক্সিডেন্টের জিনিস আমি অনেক ভয় পাই’। পরে শাবানা সেই গহনা তার ঘরে না নিয়ে অন্যত্র জায়গায় রাখেন। পরে স্থানীয় প্যানেল মেয়রের মাধ্যমে যোগাযোগ করে গহনার প্রকৃত মালিককে বুঝিয়ে দেয়া হয়।
শাবানা জানান, প্রায় ১ ভরি ১০ আনা স্বর্ণের গহনাটি যখন সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত লিটন মণ্ডলের স্ত্রী কল্পনা বেগম ও তার পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়, তখন কল্পনা তাকে জানান, এই গহনার বিষয়ে তার স্বামী তাকে কখনোই জানায়নি। বরং দুর্ঘটনার দিন বিকেলে তার স্বামী নিহত লিটন ভাঙ্গা থেকে নগরকান্দার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েই বলেছিলেন তার জন্য একটি সারপ্রাইজ আছে। সেটা সে বাড়িতে পৌঁছে তাকে জানাবে। যদিও তার স্বামীর হাতে সেই সারপ্রাইজ তিনি পাননি। তবে, তার স্বামীর শেষ স্মৃতিটুকু কাওসারের মাধ্যমে পেয়েছেন, যা বর্তমানে সততার একটি দৃষ্টান্ত ঘটনা।
কাউসার মাতুব্বর সড়ক দুর্ঘটনার পর তার ভূমিকা উল্লেখ করে বলেন, তিনি সেখানে উদ্ধার কাজে অংশ নেন। এসময় কিছু স্বর্ণের গহনা তিনি পান। পরবর্তীতে স্থানীয় মাতুব্বর ও প্যানেল মেয়রের মাধ্যমে ভাঙ্গা পৌরসভায় প্রকৃত গহনার মালিককে বুঝিয়ে দেয়া হয়। এমন মহৎ কাজটি করতে পেরে তিনি নিজের মনে অনেক শান্তি অনুভব করেছেন।
কাউসার সবার উদ্দেশ্য বলেন, মানুষকে একদিন মরতে হবে। তাই, মরণের কথা স্মরণ করেই চলতে হবে। পরবর্তীতে যদি কোন দুর্ঘটনা ঘটে এবং কোন মানুষ বিপদে পড়েন তাদের পাশে সবাইকে এগিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
প্রতিবেশীরা জানায়, কাউসার একজন ভালো মনের মানুষ। সে বরাবরই মানুষের বিপদে দৌড়ে যায়। তার এমন মহৎ কাজটি সততার এক বিরল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। এতে সমাজের সবাই মহৎ কাজে আরও অনুপ্রাণিত হবে। কাউসারের জন্য তারা গর্বিত।
ভাঙ্গা পৌরসভা ১নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও প্যানেল মেয়র আইয়ুব আলী জানান, দুর্ঘটনাস্থল থেকে কুড়িয়ে পাওয়া গহনার ওজন প্রায় ১ বরি ১০ আনার মতো, যার বাজার মূল্য প্রায় দেড় লাখ টাকা। তবে, সেই গহনা কাউসারসহ তার ওয়ার্ডের কয়েকজন উদ্ধার করে তার কাছে নিয়ে আসেন। এরপর গত রোববার ভাঙ্গা পৌরসভায় নিহত লিটন মণ্ডলের স্ত্রী ও সন্তানের হাতে তুলে দেয়া হয়। এ ঘটনায় তার নিজ এলাকা ও ভাঙ্গা পৌরসভায় একটি সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে।
Somajer Alo24
Leave a Reply